বহুল আলোচিত রাজধানীর পিলখানায় বিডিআর বিদ্রোহের নামে ৫৭ সেনা কর্মকর্তা নৃশংস হত্যাকাণ্ডের ১৫ বছর পেরিয়ে গেছে। মামলার এখনও চূড়ান্ত নিষ্পত্তি হয়নি। মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত ও যাবজ্জীবন দণ্ডপ্রাপ্ত আসামিদের খালাস চেয়ে করা আপিল ও মৃত্যুদণ্ড বহাল চেয়ে রাষ্ট্রপক্ষের আপিল এখনও সর্বোচ্চ আদালতে বিচারাধীন।
এদিকে পিলখানায় নির্মম হত্যাকাণ্ডের ঘটনায় অন্তর্বর্তী সরকারের গঠন করা জাতীয় স্বাধীন তদন্ত কমিশনের কাজ চলমান রয়েছে। নেপথ্যের ইন্দনদাতাদের খুঁজে বের করতে এই কমিশন এরই মধ্যে ৩৭ জনের সাক্ষ্যগ্রহণ করেছে। তাই পিলখানা হত্যা মামলার ভবিষ্যৎ কোন দিকে যাবে তা এখনও স্পষ্ট নয়। রাষ্ট্রপক্ষের আইনজীবীদের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলেও তারা এই মামলা নিয়ে কোনো বক্তব্য দিতে রাজি হননি। তবে আসামিদের আইনজীবী দ্রুত পিলখানা হত্যা মামলার আপিল শুনানি ও নিষ্পত্তি করতে প্রধান বিচারপতির প্রতি অনুরোধ জানিয়েছেন।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে আসামিপক্ষের আইনজীবী মো. আমিনুল ইসলাম বলেন, সাজাপ্রাপ্ত ২২৬ জনের পক্ষে আমরা আপিল করেছি। আপিলগুলো এখন পর্যন্ত পেন্ডিং রয়েছে। এটি শুনানির জন্য আপিল বিভাগের কার্যতালিকায় আছে। প্রতি সপ্তাহে মামলাটি কার্যতালিকায় আসে। কিন্তু আমরা সেটি শুনানির সুযোগ এখন পর্যন্ত পাচ্ছি না। আমি মাননীয় প্রধান বিচারপতির কাছে বিনয়ের সঙ্গে অনুরোধ জানাতে চাই, ন্যায় বিচারের স্বার্থে দ্রুত শুনানি ও নিষ্পত্তির জন্য আমি আকুল আবেদন জানাচ্ছি। পাশাপাশি একই ঘটনায় বিস্ফোরক আইনের মামলাটি সেটির বিচার কাজ নিম্ন আদালতে আবার শুরু হয়েছে।
তিনি আরও বলেন, বিচার কাজ শুরু হওয়ার পর এই মামলায় এখন পর্যন্ত ২৮৫ জনের সাক্ষ্যগ্রহণ হয়েছে। এই মামলায় তেরশ জনের বেশি সাক্ষী। শেষ হতে আরও সময় লাগবে। হত্যাকাণ্ডের মামলায় ২৭৭ আসামি খালাসপ্রাপ্ত ছিল। ২৫৬ জন আসামির সাজা ছিল। যাদের ১০ বছরের সাজা ছিল, তাদের সাজাটা ইতোমধ্যে শেষ হয়েছে। খালাস প্রাপ্তদের মধ্যে গত ৯ জানুয়ারি ১৭৮ জন আসামি মুক্তিলাভ করেছেন। খালাস প্রাপ্ত অন্যদের পক্ষেও আমরা জামিন আবেদন করেছি। সাজা শেষ হওয়া ২৫৬ জন আসামির পক্ষেও আমরা জামিন আবেদন করেছি। আগামী ১৩ মার্চ বিচারিক আদালত এ বিষয়ে আদেশ দেবেন। আমরা মনে করি শহীদ পরিবারের যেমন ন্যায় বিচার পাওয়ার অধিকার আছে, তেমনি যারা নির্দোষ তাদেরও ন্যায় বিচার পাওয়ার অধিকার রয়েছে। আবারও আমরা মাননীয় প্রধান বিচারপতির কাছে দ্রুত এই মামলার আপিল নিষ্পত্তি করার আর্জি জানাচ্ছি।
২০২০ সালের ৭ জানুয়ারি পিলখানায় বিডিআর বিদ্রোহে সেনা কর্মকর্তা হত্যাকাণ্ডের মামলায় নিম্ন আদালতে ফাঁসির দণ্ডপ্রাপ্ত ১৫২ জনের মধ্যে ডিএডি তৌহিদসহ ১৩৯ জনের মৃত্যুদণ্ড বহাল রেখে রায় প্রকাশ করে হাইকোর্ট। পৃথিবীর ইতিহাসে অন্যতম বড় এ মামলার ২৯ হাজার ৫৯ পৃষ্ঠার রায় প্রকাশ করা হয়।
রায়ে বিচারিক আদালতে মৃত্যুদণ্ড পাওয়া আট আসামিকে যাবজ্জীবন এবং চারজনকে খালাস দেন আদালত। একইসঙ্গে বিচারিক আদালতে যাবজ্জীবন পাওয়া ১৬০ জনের মধ্যে ১৪৬ জনের সাজা বহাল রাখা হয়। বিচারিক আদালতে যাবজ্জীবন পাওয়া আওয়ামী লীগের ওয়ার্ড নেতা তোরাব আলীসহ ১২ জনকে খালাস দেন আদালত।
বিচারপতি মো. শওকত হোসেনের নেতৃত্বাধীন তিন সদস্যের বিশেষ হাইকোর্ট বেঞ্চ এ রায় ঘোষণা করেন। বেঞ্চের অপর দুই সদস্য হলেন- বিচারপতি মো. আবু জাফর সিদ্দিকী ও বিচারপতি মো. নজরুল ইসলাম তালুকদার।
এছাড়া বিচারিক আদালতে তিন থেকে ১০ বছর পর্যন্ত বিভিন্ন মেয়াদের কারাদণ্ডপ্রাপ্ত ২৫৬ আসামির মধ্যে ১০ বছরের কারাদণ্ডের আসামি ১২৮ জন, ৮ জনকে সাত বছর, চারজনকে ৩ বছর এবং ২ জনকে ১৩ বছর করে কারাদণ্ড দেওয়া হয়েছে। ২৯ জন খালাস পান, ২৮ জন আপিল করেনি এবং ৩ জন মারা গেছেন।
এদিকে বিচারিক আদালতে খালাস পাওয়া ৬৯ জনের মধ্যে ৩১ জনকে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড ও ৪ জনকে ৭ বছর করে কারাদণ্ড দেন হাইকোর্ট, এছাড়া ৩৪ জনকে খালাস দেন। দুই দিনব্যাপী উপমহাদেশের মধ্যে বৃহত্তম এ মামলার রায় ঘোষণা করা হয়।
২০১৫ সালে এ মামলায় বিচারিক আদালতে মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত আসামিদের ডেথ রেফারেন্স ও আপিলের শুনানির জন্য বৃহত্তর বেঞ্চ গঠন করা হয়।
এই বেঞ্চে ৩৭০ কার্যদিবস আসামিদের আপিল ও ডেথ রেফারেন্সের ওপর শুনানি হয়। ওই সময়ের অ্যাটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলমসহ বিভিন্ন আইনজীবী শুনানিতে অংশ নেন।
২০০৯ সালের ২৫ ও ২৬ ফেব্রুয়ারি তৎকালীন বিডিআরের সদর দপ্তরে ৫৭ সেনা কর্মকর্তাসহ ৭৪ জন প্রাণ হারান। ওই বছরের ২৮ ফেব্রুয়ারি লালবাগ থানায় হত্যা ও বিস্ফোরক আইনে দুটি মামলা হয়। পরে মামলা দুটি নিউমার্কেট থানায় স্থানান্তরিত হয়। বিচার হয় ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারসংলগ্ন আলিয়া মাদ্রাসা মাঠসংলগ্ন অস্থায়ী এজলাসে। বিচার শেষে ঢাকা মহানগর তৃতীয় বিশেষ আদালতের বিচারক মো. আখতারুজ্জামান ২০১৩ সালের ৫ নভেম্বর রায় ঘোষণা করেন।
রায়ে বিডিআরের প্রাক্তন ডিএডি তৌহিদসহ ১৫২ জনকে মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হয়। এছাড়া বিএনপি দলীয় প্রাক্তন সংসদ সদস্য নাসিরউদ্দিন আহমেদ পিন্টু (প্রয়াত) ও স্থানীয় আওয়ামী লীগ নেতা তোরাব আলীসহ ১৬০ জনকে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড এবং ২৫৬ জনকে বিভিন্ন মেয়াদে সাজা দেওয়া হয়। অভিযোগ প্রমাণিত না হওয়ায় ২৭৭ জনকে খালাস দেওয়া হয়। এ ঘটনায় বিস্ফোরক আইনে দায়ের করা মামলাটি এখনো নিম্ন আদালতে বিচারাধীন রয়েছে।