রাজধানীর বিমানবন্দর-গাজীপুর রুটে বাস র্যাপিড ট্রানজিট (বিআরটি) প্রকল্পের অনেক কাজ এখনো বাকি। এরই মধ্যে জোড়াতালি দিয়ে আজ থেকে চালু হচ্ছে বিআরটি প্রকল্পের বাস পরিষেবা। কোম্পানির নিজস্ব বাস এখনো কেনাই হয়নি। ২৫টি স্টেশনের কোনোটিরই কাজ এখনো শেষ হয়নি। ফুটপাত থেকে শত সিঁড়ি বেয়ে যেতে হবে মাঝ রাস্তার স্টেশনে। সেখানে যাওয়ার এস্কেলেটরগুলো স্টেশনের রাস্তায় রাখা ছিল, যার অধিকাংশই আন্দোলনের আগুনে ক্ষতিগ্রস্ত ও লুটপাট হয়েছে। ক্ষতির পরিমাণ শতকোটি টাকার বেশি। চলতি মাসেই প্রকল্পের ষষ্ঠবারের বর্ধিত মেয়াদ শেষ হচ্ছে। অসমাপ্ত কাজ শেষ করতে সপ্তমবারের মতো মেয়াদ বাড়ানোর প্রস্তাব করা হচ্ছে।
এই পরিস্থিতিতে সরকারি পরিবহন সংস্থা বিআরটিসির ১০টি এসি বাস দিয়ে আজ থেকে বিআরটি লেনে বাস পরিষেবা চালু করা হচ্ছে। আজ সকালে বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন করপোরেশনের (বিআরটিসি) পরিচালনায় গাজীপুর শিববাড়ি বিআরটি লেনে বিআরটিসি এসি বাসের উদ্বোধন করবেন সড়ক পরিবহন ও সেতু মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা মুহাম্মদ ফাওজুল কবির খান।
বিজ্ঞাপন
মন্ত্রণালয়ের বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়, প্রাথমিকভাবে ১০টি বিআরটিসি এসি বাস শিববাড়ি বিআরটি টার্মিনাল থেকে বিআরটি লেনে এয়ারপোর্ট পর্যন্ত ২০.৫ কিলোমিটার এবং এয়ারপোর্ট থেকে গুলিস্তান পর্যন্ত ২২ কিলোমিটার মিলিয়ে ৪২.৫ কিলোমিটার পথে চলবে। শিববাড়ি থেকে এয়ারপোর্ট পর্যন্ত ভাড়া ৭০ টাকা এবং শিববাড়ি থেকে গুলিস্তান পর্যন্ত ভাড়া ১৪০ টাকা। যাত্রী চাহিদা এবং স্টেশনগুলো সম্পূর্ণ প্রস্তুত হলে বাস বাড়ানো হবে। বিআরটি লেন চালুর সুবিধার্থে গত কয়েক দিন ধরে বিমানবন্দর-গাজীপুর রুটের বিভিন্ন স্থানে রেলিং দিয়ে লেন পৃথক করা হচ্ছে। মাঝখানে ফাঁকা পড়ে আছে বিআরটি লেনের অংশ। গত কয়েকদিন ধরে তীব্র যানজট হচ্ছে টঙ্গী-উত্তরা এলাকায়। এই প্রকল্পের লেন শুধু বিআরটিসি বাসের জন্য নির্ধারণ করে দেওয়ার পর মহাসড়কে যানজট বাড়ছে বলে জানিয়েছেন স্থানীয় বাসিন্দারা।
ক্রমবর্ধমান যানজট নিরসনে বিমান বন্দর থেকে গাজীপুর চৌরাস্তা পর্যন্ত ২০১২ সালে নেওয়া প্রকল্পটির শুরুতে ব্যয় ধরা হয়েছিল ২ হাজার ৩৯ কোটি টাকা। কয়েক দফায় সময় ও বরাদ্দ বাড়িয়ে প্রকল্পের সর্বশেষ ব্যয় দাঁড়াচ্ছে ৪ হাজার ২৬৮ কোটি টাকা। এই প্রকল্পে যৌক্তিক কোনো কারণ ছাড়াই খরচ বাড়াতে বিমান বন্দর, জসীমউদ্দীন, হাউস বিল্ডিং, কুনিয়া, উন্মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয়, ভোগড়া এবং জয়দেবপুর চৌরাস্তায় সাতটি ফ্লাইওভার নির্মাণ করা হয়েছে। টঙ্গী ব্রিজকে ১০ লেনে উন্নীত করা হয়েছে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, টঙ্গী ব্রিজ ছাড়া বাকি ফ্লাইভারগুলোর কোনোই প্রয়োজন ছিল না।
বিআরটি প্রকল্পের সার-সংক্ষেপে বলা হয়েছে, বিআরটি বাস্তবায়িত হলে ১০০টি আর্টিকুলেটেড বাসের মাধ্যমে ঘণ্টায় ২৫ হাজার মানুষ যাতায়াত করবে। ঢাকা-ময়মনসিংহ মহাসড়কে যানজট অনেকটাই কমে যাবে। কিন্তু অতিলোভী কর্মকর্তাদের কারণে প্রকল্পে আর্টিকুলেটেড বাসের ব্যবস্থা পরিত্যক্ত হয়েছে। ভলবো বাসের পর এই বাসেরই প্রতিটির দাম ছিল কোটি টাকার বেশি। মন্ত্রণালয় এবং বিআরটিসির অতি আগ্রহী কর্মকর্তাদের তৎপরতায় প্রতিটি ১ কোটি ১১ লাখ টাকা করে বিআরটিসির জন্য ২০১৩ সালে ৫০টি আর্টিকুলেটেড বাস কেনা হয়। এসব বাসের অধিকাংশই মাত্র সাত বছরেই ২০০০ সালের মধ্যে অকেজো হয়ে পড়ে। বর্তমানে এসব বাসের প্রায় সবই ডিপোতে পড়ে আছে। কালেভদ্রে দুই-একটি বাস রাস্তায় দেখা যায়। অভিযোগ রয়েছে, লুটপাটের উদ্দেশ্যেই তড়িঘড়ি করে প্রকল্প শুরুর অনেক আগেই এসব বাস কেনা হয়। বিআরটি প্রকল্পে এখন আর্টিকুলেটেড বাসের পরিবর্তে স্ট্যান্ডার্ড বাস পরিচালনার কথা বলা হচ্ছে। বিশেষায়িত বাস লেনের প্রকল্প হলেও এই লেনে ব্যক্তিগত গাড়িও চলবে।
বিআরটি বিশ্বব্যাপী জনপ্রিয় পরিবহন মাধ্যম, বিশ্বের অনেক দেশে সমাদৃত। কিন্তু বাংলাদেশে দীর্ঘ ভোগান্তি, বিপুল অর্থ ও সময় ব্যয়ের পর জোড়াতালি দিয়ে চালু করা হচ্ছে বিআরটি প্রকল্প। সোয়া ৪ হাজার কোটি টাকার বিআরটি প্রকল্পে অসংখ্য নির্মাণ ত্রুটি চিহ্নিত হয়েছে। পরিকল্পনায় ত্রুটির কারণে প্রকল্পসংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারাই এটিকে রুগ্ণ প্রকল্প আখ্যা দিয়েছেন।
বিআরটি প্রকল্পের স্টেশন এলাকায় সিঁড়ির কারণে ফুটপাত সংকুচিত হয়ে পড়েছে। যাত্রীদের চলাচল করতে হয় সড়কে নেমে। প্রকল্পটির চান্দনা চৌরাস্তা থেকে শিববাড়ি মোড় পর্যন্ত ৭ কিলোমিটার সড়কের কোথাও ফুটপাত রাখাই হয়নি, কোনো ইউটার্নও নেই। বিআরটি প্রকল্প নিয়ে গত ২৭ মার্চ গাজীপুরে গণশুনানির পর শুধু কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউট থেকে শিববাড়ি পর্যন্ত এক থেকে দেড় ফুট প্রস্থের ফুটপাত বানানো হয়েছে। ভোগড়ায় ফ্লাইওভারের উচ্চতা কম, সরু ড্রেনের কারণে মহাসড়কে পানি জমে থাকে। বিআরটি স্টেশনে যাতায়াতের জন্য নির্মিত ৭২ ফুট উঁচু সিঁড়ি বয়স্ক মানুষ, মহিলা ও শিশুদের ভোগান্তি বাড়াবে। ২৫টি স্টেশনের মধ্যে উত্তরায় রাজলক্ষ্মী ও জসীমউদ্দীনে কোনো স্টেশন নেই। জনবিরান র্যাব অফিসের সামনে স্টেশন করা হয়েছে, যেটি বিমানবন্দর থেকে খুবই কাছে। বিআরটি লেন নির্মাণের আগে মহাসড়কের প্রশস্ততা ছিল ১০০ ফুট। ওই মহাসড়ক দিয়ে দেশের উত্তর ও উত্তর-পশ্চিমাঞ্চলের যানবাহন চলে। কিন্তু মাঝখানে বিআরটি লেনের কারণে এখন মহাসড়ক খুব সরু হয়ে পড়েছে। ফলে যানজট লাগছে সড়কের বিভিন্ন পয়েন্টে। এমন অসংখ্য অসংগতি নিয়ে চালু হচ্ছে বিআরটি করিডর।
গাজীপুরে ঢাকা প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের (ডুয়েট) সিভিল ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের অধ্যাপক মো. মোজাম্মেল হক বলেন, গাজীপুর থেকে টঙ্গী পর্যন্ত অনেক পোশাক কারখানা রয়েছে। এসব কারখানার শ্রমিকদের চলাচলের জন্য পর্যাপ্ত ফুটপাত রাখা হয়নি। আমরা শুরু থেকেই প্রকল্পটির বিরোধিতা করেছি। এখন যেহেতু কাজটি হয়ে গেছে, তার সুফল কীভাবে পাওয়া যায় সেটাই দেখা উচিত।